অপেক্ষা

অদ্য যামিনির মত সেই রাত্রিও ছিল ভরা বর্ষার।ভাদ্রের নিকষ কালো মেঘরাশি কলিকাতাকে আপণ বক্ষ মাঝে জড়াইয়া ধরিয়া অবিরাম ধারায় স্নিক্ত করিতেছে। । ভগবান প্রতিজ্ঞা করিয়াছে আজকেই কলিকাতার সমস্ত ক্লেদ বর্ষার নবীন ধারায় ধুইয়া দিবে। তাহার ওপর অমাবস্যা।দূরে ঝি ঝি পোকা ও ভেকের ডাকে চারিধারে এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হইয়াছে। পার্শ্ববর্তী কদম্ব ফুল টুপ টুপ করিয়া মাটিতে পড়িতেছে, যেমন সদ্যস্নাত রমণীর কেশরাশি হতে বারির ধারা তৃষিত দেহপেলোবের ওপর ঝরিয়া পড়ে। এই দুর্যোগের রাত্রে আমাদের গল্পের নায়িকা সুলোচনা একাকী বিরহীনি রাধিকার মত মেডিক্যাল কলেজের ইডেন বিল্ডিংয়ের গাড়ি বারান্দায় কেনো দাড়াইয়া আছে?। সেই প্রশ্নের উত্তরে নাহয় পরে আসি,আগে বলে দিলে গল্পের সাসপেন্স নষ্ট হয়ে যায়। যাহ, সাধু ভাষা আর ধরে রাখা গেলো না, আসলে বাংলায় মাধ্যমিকে টেনেটুনে পাশ করেছি তো, বাকি গল্পটা নাহয় চলিতেই থাক।
     গুরুজনেরা বলে গেছেন যে কোনো গল্প শুরুর আগে তার স্থান কাল পাত্র বিবেচনা করা খুব দরকারি। স্থান কাল আগেই বলে দিয়েছি, তাই এবার পাত্র,থুড়ি পাত্রীর কথাতে আসি।সুলোচনা,নামটা ভারী মিষ্টি। মা মরা মেয়েটার ভালোবেসে বাপ যখন নাম রেখোছিলো, তখন অদৃষ্ট বোধয় কোথাও মুচকি হাসি হেসেছিল। মেয়ে মায়ের রূপ হয়তো পেয়েছে খানিকটা,কিন্তু রংটা পুরো বাপের -- নিকষ কালো। তা সেই ছোট মেয়েটি মেডিক্যালের গণ্ডি পেরিয়ে এখন ইন্টার্নশিপ , ডাক্তার হওয়ার শেষ গণ্ডি । আজকেই ইন্টার্নশিপের প্রথম দিন, ইমার্জেন্সী ডিউটি।

 " দশটা বাজতে যায়, ছেলেটার যদি একটুকু বুদ্ধিশুদ্ধি থাকে, কতবার পই পই করে বলে দিলাম সময়ে আসতে" রাগে গজগজ করতে করতে সুলোচনা বলে উঠলো। তা এই ছেলেটা হচ্ছে এই অধম, সুমন্ত্র অধিকারী,বাড়ি নদীয়া, পিতার নাম শ্রীযুক্ত ....থাক নিজের বংশ পরিচয় দিয়ে গল্পটাকে বড় করে লাভ নেই। শুধু যেটুকু না বললেই নয় এই গল্পের প্রয়োজনে সেটুকু বলি। এই বখাটে ছেলেটি সিটি কলেজে পড়ে, ফাইনাল ইয়ার, সুলোচনার সাথে গত বছর পরিচয়, ওদের কলেজে ফেস্ট এ। সুলোচনা সেদিন একটা নীল রঙের শাড়ি পড়েছিল, বসন্তের পড়ন্ত বেলায় আমি যখন ওকে প্রপোজ করেছিলাম লজ্জায় ওকে খুব মিষ্টি লাগছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গঙ্গার বুকে অনেক জল বয়ে গেছে তারপর থেকে, কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলেই ওর একটাই উত্তর, আগে পড়াশুনো শেষ হোক তারপর ভাবা যাবে। সেই পড়াশুনোর তো কোনো শেষ আমি দেখতে পাই না, মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ডাক্তারি পড়াটাই বোধহয় আমার সতীন। রাগ হয় মাঝে মাঝে, আবার যখন ভিক্টোরিয়ার মাঠে আমার কোলে মাথা রেখে মেয়েটা ভুল ভাল বকে যায়,তখন কি এক অদ্ভুত অনুভূতি তে মনটা ভরে ওঠে। পুরনো স্মৃতি আরো অনেক কিছু মনের মাঝে উঁকি মারছিল, কিন্তু চিন্তার সূত্রটা ছিঁড়ে গেলো সুলোচনার মোবাইলের আওয়াজে। বেজার মুখে সুলোচনা ফোনটা ধরে বললো,” হ্যাঁ, আশীষ বল। ..... আচ্ছা তুই চলে যা, আমি পাঁচ মিনিটে ইমার্জেন্সী তে ঢুকছি....না না,দেরি হবে না।" ফোনটা রাখতেই খুব কাছে প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়লো। বিদ্যুতের ঝলকানিতে দেখলাম,মেয়েটার মুখটা রাগে একেবারে লাল হয় গেছে। রাগলে কিন্তু মেয়েটাকে বেশ মিষ্টি লাগে।
“নাহ, ছেলেটার ভাগ্যটাই খারাপ, আর ৫মিন দেখবো", রাগে গর গর করতে করতে সুলোচনা র স্বগোক্তি। তা পাঁচ মিনিট এর পর আরো পাঁচ মিনিট গেলো।“ কতবার বলেছি যে ফোন সবসময় চার্জ দিয়ে রাখবি, কাজের সময় দেখো ফোন নট রিচাবল।“ রেগে,দুমড়ে মুচড়ে আর্চিজেস কার্ডটা ফেলে দিয়ে লম্বা লম্বা পায়ে সুলোচনা ইমার্জেন্সির দিকে এগিয়ে গেলো। স্ট্রীট লাইটের মৃদু আলোয় দেখলাম কার্ডটা, লেখা আছে " বেসেছিলাম ভালো তোমায়,বোঝনি কি তুমি, অধরে তে......",ফাউন্টেন পেন এ লেখা বাকিটা বৃষ্টির ধারায় ধুয়ে গেছে।

মেডিক্যালের ইমার্জেন্সী। ঢুকতে গিয়েই সুলোচনা দেখলো বিশাল ভিড়। “সরুন সরুণ, আমাকে দেখতে দিন”। জটলা সরিয়ে এগিয়ে এসে দেখলো একটা ট্রলিতে রাখা রক্তাত্ব দেহ ,নিথর। বুকটা কেমন করে উঠলো। মুখটা অন্যদিকে ঘোরানো। কাছে গিয়ে পালস দেখবে বলে ছেলেটার ঠান্ডা হাতটা তুলতেই, হাতের মুঠো থেকে একটা ছোট্ট আংটি টং করে মাটিতে পড়ে গেল। " সুমন্ত্র"।তারপর হঠাৎ চারিধারে একটা বিশাল কোলাহল," কেউ ধর ধর, ডাক্তার অজ্ঞান হয়ে গেছে, আরে জল আন।" পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো,"ইশ আর পাঁচটা মিনিট আগে যদি ডাক্তার আসতো। ডাক্তারের অপেক্ষা করতে করতেই ছেলেটা মারা গেলো”

Comments

Popular posts from this blog

The misadventures of Tawang

Bai tu long bay.....the land of the dragons

Sri Lanka - the land of experiences!