Bromo র চিঠি

                                                Mount Bromo crater
                                                 July ১৯, ২০২৪

তিলু,
প্রথমেই Selaaamat pagiiiiiiiii( এই টান টা না দিলে ঠিক সকালটা মিষ্টি হয় না এ দেশে)। 

সবেমাত্র সিগারেটে সুখটান দিয়ে বসে পা গুলো ছাড়াচি,হঠাৎ করে তোর মিষ্টি মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কেনো বল তো? মনটা বড্ড বেয়াড়া হচ্ছে আজকাল,ঘুরতে এসে নিজেই ঘুরতে বেরিয়ে গেছে। আসলে এর আগের যত পাগলামি খাপ্যামি এডভেঞ্চার সব তো তোর সাথেই তো, তাই মনটা আজ বিবাগী বাউন্ডুলে হ্য়ে গেছে তুই নেই বলে। কি আর করা যাবে, কত করে তোকে আসতে বললাম, তুই ছুটির দোহাই দিয়ে কেনো যে এলি না, bromoi জানে? ভাবছিস Bromo কি....একটু সবুর কর,তুই না বলেছিলিস, সবুরে মেওয়া ফলে। তা যাইহোক,  এই কাকভোরে (যদিও এই দেশে কাক এক পিস ও চাক্ষুষ দেখলাম না) যখন তোর কথা মনে পড়েই গেছে,ভাবলাম খস খস করে একপাতার চিঠি লিখে ফেলি, তোকে আজকের এডভেঞ্চারের একটু মানস ভ্রমণ করাই। দেখ দুধের স্বাদ যদি ঘোলে মেটাতে পারিস । ইস, ciggerate টা শেষ হয়ে গেলো, দাঁড়া আর একটা ধরাই।

তারপর যা বলছিলাম, গুরুদেব বলে গেছেন গৌরচন্দ্রিকা শেষ হলেই স্থান কাল পাত্র আগে বলে রাখবি (গুরুদেব সত্যি বলেছেন কি, না বললেও ক্ষতি নেই, কপিরাইট অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, বিশ্বভারতী আর কেস করবে না।) পাত্র কে তো ভালো ভাবেই চিনিস, তাই তার সম্বন্ধে কলমের কালি খরচ করা নিষ্প্রয়োজন। স্থান চিঠির প্রথমেই লিখেছি, তাও বিশদে বলছি পরে। "কাল" দিয়েই শুরু করা যাক। এখানে ভোর ৪:৩০ (তোদের থেকে ১ ঘণ্টা ৩০মি এগিয়ে আছি)। যে জায়গায় বসে আছি,  সেটা একটা সরু এক চিলতে রাস্তা , পাশাপাশি দুজন হাঁটা দুষ্কর। রাস্তার দুধারেই গভীর খাদ, যমরাজ দুবাহু প্রশস্থ করে আমায় শীতল আলিঙ্গনে আবদ্ধ (নাকি বধ্য) করতে উন্মুখ হয়ে আছেন। আমার পশ্চাতে এক বিশালা দৈত্যাকার কৃষ্ণগহ্বর ,সেখান থেকে  ভস্সুরের চাপা ক্রুদ্ধ গর্জন ক্রমাগত কানের পর্দায় মুহুর্মুহু আঘাত করছে। আর তার সাথে মহাদেবের কল্কে থেকে নির্গত অবিরাম অফুরন্ত ধূম্রোরাশির ন্যায় চারিদিকের আকাশ বাতাস ধূমায়িত করে রেখেছে। পার্থক্য শুধু একটাই, এই ধোঁয়া মোটেও নেশায় বুদ করছে না, বরং এর তীব্র ঝাঁঝে আমার অবস্থা যথেষ্ট সঙ্গীন। কিন্তু এটা মানতে হবে, আওয়াজটার মধ্যে একটা মাদকতা আছে, কি করে যে তোকে বোঝাই ---  আপাতদৃষ্টিতে random, কিন্তু এর মধ্যেও একটা pattern in madness আছে, একটা প্রাচীন কোনো মন্ত্র অবিরাম গতিতে পড়ে যাচ্ছে, যার মানে হয়তো কোন এক কালে প্রাচীন মানুষেরা জানত, কিন্তু সভ্যতার প্রলেপে আজ আমরা ভুলতে বসেছি। এই তো গেলো পেছনের কথা, সামনের কথা আরও বিপজ্জনক। সামনে বিশাল খাদ, কিন্তু সেই খাদের গভীরতা ঠিক ঠাহর করতে পারছি না। কারণ মেঘ। এত সুন্দর মখমলে পেঁজা তুলোর মত মেঘ আমি জীবনে কখনও দেখিনি। পাহাড়ের ক্ষত বিক্ষত খাদের কিনারা় থেকে পুরো দিগন্ত বিস্তৃত সাদা মেঘের গালিচা মিশে গেছে নীল আকাশের সাথে। সেই নীল আকাশে এখন রঙের খেলা। পুবের আকাশ যে কি মোহময়ী হয়ে উঠেছে তোকে কি আর বলবো, সেখানে পুরো রঙের খেলার মাতোয়ারা। ঊষার এই লাস্যময়ী রূপ না দেখলে বর্ণনা করা খুব কঠিন।যুগ যুগ ধরে কত কবি এর বন্দনায় শ্লোক রচনা করেছেন, কিন্তু কোনো শ্লোকই কোনো কবিতাই এই ভয়ঙ্কর সুন্দর জায়গার অভিজ্ঞতা কে তুলে ধরতে পারবে না। মেঘের চাদর থেকে অলস দুষ্টু ছেলের মত সূর্য একটু একটু উঁকি মারছে। সেই ভোরের আলোয় দেখলাম, কিছুটা দূরে এক বিদেশি কপোত কপোতী নিবিড় চুম্বনে মত্ত। তাদের গাইড মৃত্যুর এই আবহের মাঝে জীবনের এই জয়গান ক্যামেরা বন্দি করে রাখছে স্মৃতি হিসেবে। সত্যি তো, এ এমন এক জায়গা যেখানে শুধু ভালবাসার মানুষটার সঙ্গে পাশে বসে থাকা যায় , সময় এখানে এসে থমকে গেছে, এখানে সমাজ জগৎ, তার নিয়ম কানুন সব মিথ্যে, সত্যি শুধু এই মুহূর্তটা। উফ, কি সব আজ বাজে বকছি , আগ্নেয়গিরির গ্যাসটা ক্রমশই অসহ্য হয়ে উঠছে। সামনে কিছু একটা সাইন বোর্ডে লেখা আছে, সে থাক.....সামনের দিকে এগিয়ে যাই। যেতে যেতে তোকে আজকের এডভেঞ্চারের কথা বলি।


  ঘুমটা ভেঙে গেছে রাত দুটোয়। Homestay er বাকি গেস্ট Pannajan hill summit এ যাবে সূর্যোদয় দেখতে। আমরা গতকালই সেই অপরূপ দৃশ্য দেখে এসেছি, তাই আজকে ঠিক হয়েছে যে Bromo r crater  থেকে সূর্যোদয় দেখব। Bromo আসলে বাংলায় যাকে বলিস ব্রহ্ম। এখানকার Tengeresse tribal লোকেরা june er সময় Yadna kasada পরবে crater এর মধ্যে ফুল ফল কলা মুলো এমনকি ছাগল গরুও দেবতাকে তুষ্ট করতে অর্পণ করে।তুই তো জানিস আমি সর্বভুক। তাই  এক সর্বভুক আরেক সর্বভুক সদাজাগ্রত ( Bromo active volcano) পরম ব্রহ্মকে দেখার লোভ কিছুতেই সংবরণ করতে পারল না।রেডি হয়ে তাই জীপ গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম তিন সহযোদ্ধা , আমি, অভিক আর ভাস্কর। আঁকবাঁক পাহাড়ি রাস্তা আর ঘন জঙ্গল ও ঘুমন্ত জনপদ অতিক্রম করে আমাদের ছোট্ট লাল জীপ উল্কাগতিতে এগিয়ে চলল ঘন কুয়াশা ভেদ করে। তারপর শুরু হলো সেই ভীষণ ভয়ঙ্কর treacherous Sea of Sand। Volcano r ধ্বংসলীলার ধ্বংসাবশেষ। দিগন্ত বিস্তৃত কালো বালির মরুভুমি, রুক্ষ প্রাণহীন। গতকাল প্রখর রৌদ্রে তার করাল বিভীষিকাময় মুখ আয়ব দেখেছিলাম, বিস্তীর্ণ কালো মরুভূমির মাঝে হলুদ ঘাসের রাশি কিছু জায়গায় মরু বিজয়ের কেতন ওড়ানোর বিফল চেষ্টায় মগ্ন। আজ রাত্রে, ঘন কুয়াশায় তাকে মনে হচ্ছে এক কুহকিনী ডাকিনী, পথ হারানো শ্রান্ত দিকভ্রান্ত পথিককে মায়াবী ডাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে নিজের জঠর অনলে। আমাদের ড্রাইভার যে কি করে এই মহাশূন্যের মধ্যে দিকনির্ণয় করছে তা এক পরম বিস্ময়। যুগ যুগ ধরে মানুষ মিত্যুভয় অতিক্রম করে এই অজানা অচেনা জগতে সৌন্দর্যের হাতছানিতে প্রলোভিত হয়ে ঘর সংসারের সব মায়া অতিক্রম করে বেরিয়ে পড়েছে এক নতুন জগতের সন্ধানে। এ এক চরম বিস্ময় । চিন্তার সুতোটা কেটে গেলো, হঠাৎ করে জীপ সজোরে ব্রেক কষায়। তারপর ইন্দোনেশিয়ান ইংরিজিতে যা বলল, বাংলায় তার মর্মার্থ করলে দাঁড়ায়, এবার বাছাধন সব নেমে পড়, সামনে ব্রহ্মার মন্দির আছে, তার পাশ ধরে হাঁটলে mt Bromo পেয়ে যাবে। এই বলেই জীপএর আওয়াজ কুয়াশার মধ্যে মিলিয়ে গেলো।

এক ভয়ংকর নিস্তব্ধতা আমাদের গ্রাস করলো। এই প্রথম মনে হলো যে আমরা সম্পূর্ণ একা,নিঃসঙ্গ। ঘন কুয়াশায় আকাশের তারাও দেখা যাচ্ছে না। চারিধারে বিস্তীর্ণ মরুভুমি। তুই তো জানিস, জঙ্গলে আমি রাত কাটিয়েছি; সেখানে ভয় আছে,বিষাক্ত পোকা মাকড় আছে, কিন্তু এরকম থমথমে পরিবেশ নেই। জঙ্গলের একটা নিজস্য সঙ্গীত আছে, তার গুণমুগ্ধ শ্রোতা হিসেবে রাতের তারা আছে আকাশে। এখানে যেন প্রকৃতি গোসা করে চুপ হয়ে আছে, সে যে কখন প্রবল পরাক্রমে ঝাপিয়ে পড়বে আমাদের ওপর তার প্রতিশোধ নিতে,কে জানে। এ এক  অসস্তিকর অনুভূতি। অভিক সবার প্রথমে বলে উঠলো,চল তাহলে সোজা এগোই। টর্চ  জ্বেলে বোঝার চেষ্টা করলাম কোন দিক যেতে হবে। কিন্তু সবদিকেই সেই ধু ধূ বালির প্রান্তর আর ঘন কুয়াশা, ১ মিটার আগের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আকাশও যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে আমাদের থেকে, পূর্ণিমার রাত্রে অথচ সেখানে চাঁদের দেখা নেই। পথ বলতে বালির ওপর কিছু মানুষের ও ঘোড়ার পায়ের ছাপ।অগ্যতা তাই দেখে আমরা চলতে লাগলাম। কনকনে ঠান্ডা চারিদিকে। আফগানি ছুরির মত হিম শীতল হাওয়ায় আমাদের মুখ ঠোঁট ক্ষত বিক্ষত।তিনজনেই চুপচাপ হাঁটছি, বালিতে মাঝে মাঝে হোঁচট ও খাচ্ছি, আবার সামলে উঠে হাঁটা লাগাছি। সময় থমকে গেছে। প্রবল হতাশা এই ঘন কুয়াশার ন্যায় আমাদের গ্রাস করেছে। আমি জিগ্গেস করলাম, আর কতদূর? ভাস্কর মোবাইল এর gps দেখে বললো, আরও আধ ঘণ্টা । মনে মনে ভাবলাম, আমরা কি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি? সেই কখন থেকে আধ ঘণ্টার প্রবোধ শুনছি। অভিক যেন আমার মনের কথা শুনতে পেয়ে বলে উঠলো, চল ফিরে যাই। কিন্তু ফিরব কোথায়? জীপ তো আমাদের রেখে বেপাত্তা। এখানে এই ঠাণ্ডায় দাড়িয়ে থাকাও বিপজ্জনক, মরুভূমিতে কিছু না থাকুক সাপ আর কাঁকড়া বিছে নিশ্চই আছে। তাই, আবার সবাই হাঁটা লাগালাম...সোজা, অন্তত তাই আমাদের মনে হয়েছিল( যদিও পরে জানতে পেরেছিলাম আমরা অনেকক্ষণ আগেই ভুল রাস্তা ধরেছি)।হঠাৎ দূরে একটা আলোর বিন্দু চোখে পড়ল। মনটা আনন্দ আশায় ভরে উঠলো, ভাবলাম ওটাই বোধহয় ব্রহ্মার মন্দির,যাক ঠিক রাস্তায় আছি। তৃষ্ণার্ত পথিক যেমন মরুভূমির মাঝে মরীচিকার টানে উদভ্রান্তের মত ছুটে যায়, আমরাও সেই আলোর দিকে সবেগে হাঁটা লাগালাম।কি আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই আলো ক্রমশই আমাদের দিকে দ্বিগুণ বেগে অগ্রসর হতে লাগলো। ভয় যে পায়নি বলবো না, কিন্তু ভয় এর থেকে যেটা বেশি পেলাম সেটা স্বস্তি। যাক মানুষ,সে চোর ডাকাত যেই হোক,তার কাছ থেকে রাস্তাটা তো জানা যাবে। হঠাৎ একটা জোরালো আলো আমার মুখের ওপর পড়ল। টুরিস্ট? ভয়ে ভয়ে ঢোক গিলতে গিলতে বললাম ,Yes। এবার আলোটা আমার মুখ থেকে সরে একটা ধব ধবে সাদা ঘোড়ার মুখে পড়ল।দেখলাম ঘোড়সওয়ার একজন লোক; তখন ওকেই মনে হচ্ছিল যেন দেবদূত, স্বয়ং জিবরাইল এসেছে আমাদের উদ্ধার করতে। Need horse, ১৫০k। নির্ঘাত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার যে কি আনন্দ সে কি করে তোকে বোঝাই। এত আনন্দ বোধহয় আর কিছুতেই পায়নি..... পরে অভিক ও ভাস্করকেও জিজ্ঞেস করেছি, ওদের মনের অবস্থাও তার আগে পর্যন্ত আমার মত চরম অবসাদ ও হতাশায় ভরে গিয়েছিল। তুই কল্পনা কর, এক অচেনা অজানা জায়গায়, নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে ঘন কুয়াশায় মরুভূমির মাঝে দিকবিদিক শুন্য হয়ে আমরা হেঁটে চলেছি ১ঘণ্টা ধরে,এক অলীক নয়নাভীরাম দৃশ্য দেখার আশায়; জানি না শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌছতে পারবো কিনা l এই যে নিজের কমফোর্ট যোন থেকে বেরিয়ে অজানায় পাড়ি দেয় মানুষ, জীবনকে বাজি রেখে দুর্গম দুর্বিষহ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, তা কিসের নেশায়, কিসের লোভে! মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানিস, সংসারের চেয়ে অজানা ঢের ভালো, সেখানে কোনো expectations নেই,কেউ judge করে না তোমায়। তুমি সেথায় স্বাধীন। এরই মধ্যে আরো একটা প্রবলেম দেখা দিলো, মানুষ তিনজন, ঘোড়া এক পিস। অভিকের luggage বেশি, সর্ব সম্মতিক্রমে ওই ঘোড়াসোয়ার হলো। আমরা দুজন পরিব্রাজক, ঘোড়ার পিছু পিছু হাঁটা (বা ছোটা বলাই ভালো) লাগালাম। রাস্তা আসতে আস্তে চড়াই হতে লাগলো, নিশ্বাসেও হাপ ধরছে। ঘোড়ার আলো আস্তে আসতে দূরে মিলিয়ে গেছে, ভাষ্কর ও লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেছে অনেকটাই; আমি ঘোড়ার খুরের চিহ্ন দেখে এগোতে থাকলাম। এখন  গিরিখাতের মধ্যে হাঁটছি। এগুলো আসলো ঠিক গিরিখাত নয়, বাংলায় কি বলে জানা নেই, ইংলিশ এ বলে লাভা ট্রেঞ্চ। শক্ত পাহাড়ের ঢালে লাভার জ্বলন্ত ছুরিকাঘাতে এই  গিরিখাতের সৃষ্টি। ঠাণ্ডায় হাত জমে গেছে, তাও মোবাইলের আলোয় যতটুকু দেখা যায় আর কি। হঠাৎ হোঁচট খেলাম, আর আলো গিয়ে পড়ল রাস্তার দুধারের পাথরের গায়ে। দেখলাম ভয়ংকর সব কঙ্কালসার মুখ আমার দিকে ভেংচি কাটছে। ভয় এ হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ভেবে প্রাণপণে ছুটতে থাকলাম ভাস্করের দিকে।হাঁপাতে হাঁপাতে যখন এসে পৌঁছলাম, দেখলাম অভিক বসে সিগারেট ধরিয়েছে, দূরে পূবের আকাশে এক অদ্ভুত মায়াবী রঙের খেলা। কিছুটা দূরে একটা তোরণ মত আছে,তার একধারে শিবলিঙ্গ আর অন্যদিকে গণেশ এর মূর্তি, আর তার ওপাশেই বিশালাকার Mt Bromo। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আমরা আবার হাঁটা লাগাম সিঁড়ির উদ্যেশে; প্রায় ২৫০ টা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হয় Bromo র crater এ যাওয়ার জন্যে। কিছুটা হাঁটার পর এক তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ আমাদের চোখ মুখ নাক একেবারে জ্বালিয়ে দিলো। ব্রহ্মদেব আমাদের অভ্যুত্থানের জন্যে রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে দেখছি। ছা পোষা বাঙালির ছেলে, আর কিছু না বুঝি, এটুকু বুঝি যে কখন পশ্চাদপদ হয়ে পলায়ন করতে হয়। তাই করলাম,হিন্দি তে যাকে বলে "দুম উঠাকে ভাগনা "।নিচে নেমে এলাম, এবার আমি এক পিস ciggerate ধরলাম। মনের দুঃখ নিয়ে বসে আছি, ভাবছি কি করবো?এত কাছে এসেও হেরে যাব। অভিক বলল, sunrise হলে সালফার গ্যাস কম বেরোবে,তখন উঠবো। কিন্তু আমি কিছুতেই এই পরাজয় মেনে নিতে পারছিলাম না। ওরা ব্যাচেলর, ওরা ইচ্ছে হলেই আবার আস্তে পারবে, কিন্তু আমি তো সংসারের কারাগারে বন্দী, আমার মুক্তি তো যখন তখন নয়। মিত্যু কে আমি ভয় পাই না সেরকম, যেরকম পরাজয় কে পাই। কিন্তু একা যেতেও সাহসে কুলচ্ছেনা। হতোদ্যম হয়ে বসে পড়লাম। তিলু , মন না এক অদ্ভুত জিনিস। এই অপর্বু নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ না করে, সে কেনো হঠাৎ ২২ বছর আগের হাই স্কুলের কেমিস্ট্রি ক্লাস এ চলে গেলো সেই জানে। বোধহয় আমার চেয়ে তার তাড়া বেশি ওপরে ওঠার; আদিম কোনো প্রবৃত্তি হয়তো জেগে উঠেছিল তার মধ্যে। তা কেমিস্ট্রি তে আমাদের DKD স্যার একটা question এর ভুল উত্তর দিয়েছিলাম বলে উত্তম মধ্যম দিয়েছিল আমায়, সামান্য question, ammonia leak হলে কি করবে? উত্তরটা আজ কাজে এলো। ভেজা রুমালএ মুখে বেঁধে আবার বীর বিক্রমে হাঁটা লাগালাম। কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠেই আবার সেই Bromor ঝাঁঝালো অভ্যর্থনা। হতোদ্যম হয়ে বসে পড়লাম।এবার বোধহয় বিফল মনোরোথেই ফিরতে হবে। মনের মধ্যে আজ সারা রাত শুধু আশা নিরাশার roaler coaster চলছে। ব্যর্থ মনে দুঃখে বসে আছে, আর দূরে পূবের আকাশে ঊষা ও সূর্যের লুকোচুরি দেখছি প্রাণ ভরে। হঠাৎ অনেকগুলো টর্চ এর আলো জোনাকির মত দেখা দিলো সিঁড়ির দোরগোড়ায়,তার সাথে বিভিন্ন ভাষার কোলাহল। দেখলাম এক দঙ্গল বিদেশিনী এই দিকেই আসছে। কিছুটা সাহস পেলাম,ওরা যখন পারছে,আমরাও পারবো। আর ওপরে যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাহলে অন্তত crater e ঠেলে সদগতি করার লোক পাওয়া যাবে। তোর মুখটা খুব মনে আসছিল, ভাবছিলাম তুই থাকলে কি করতিস। তারপর জয় মা কালি বলে , (আর সম্মিলিত মনের মধ্যে হরিবোলের আওয়াজের মাঝে) আসতে আস্তে হাঁটা লাগালাম। ধীরে ধীরে একটা চাপা ক্রুদ্ধ গর্জন কানে আসতে লাগলো। ব্রহ্ম দেব আমাদের অভ্যুত্থানের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারপর ধীরে ধীরে crater দেখা দিল, উপরে উঠে এক দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লাম। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি, যে অনুভূতি শুধু কাছের মানুষের সাথে ভাগ করা যায়। বসে সবে ciggerate টা ধরলাম, তখনি তোর কথা মনে পড়লো।
      এই হলো আজকের অভিজ্ঞতা । এবার চিঠিটা শেষ করি,যাওয়ার আগে একটু বর্ণনা দিয়ে যায় এই ভয়ংকর সুন্দর সকালের (ব্যর্থ প্রচেষ্টা তাও)।  সাদা মেঘের গালিচার মধ্যে থেকে দিগন্তে সূর্য্য সবে উঁকি মারছে। পেছনে ব্রহ্ম দেবের ক্রুদ্ধ গর্জন আর ধোঁয়া এখন কানে মধুর সঙ্গীত মনে হচ্ছে। পাশেই mt Batar এর ক্ষত বিক্ষত চূড়া যেন আমারই মত এই অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না, মনে হচ্ছে চুপ চাপ বসে থাকি, পাপ পূণ্য, সমাজ সংসার, অর্থ, প্রতিপত্তি, সম্পদ, -- সব কিছুই যেন মনে হচ্ছে নশ্বর, অর্থহীন, অর্বাচীন। সময় যেন আটকে গেছে, মনে হচ্ছে এ জন্ম সার্থক হলো আজ।
Selamaat Tingaal 

পুনশ্চ: - কিছু ছবি রেখে গেলাম, বাকিটা তোর কল্পনা শক্তির ওপর আমার ভরসা আছে।
 Bromo, Batar, আর Mt Sumeru (যার মাথায় ছোট্ট ধোঁয়া)
।                       Sunset at Bromo
।               Amader jeep gaadi
।                      ঘোড়সওয়ার 
।                   কুহেলিকায় কুহুকিনী
।                  Sea of Sand
।          যেখানে বসে লিখলাম এটা
।        ভাগ্যিস অন্ধকারে দেখিনি
কি নগণ্য এই মানব জীবন (walking on the crater rim with Mt Batar in background)
celebration of life
.      Staircase to heaven
 ব্রহ্ম দেবের মন্দির (ফেরার সময় তোলা)
।                        নর কঙ্কাল
crater er ওপর -- ওম বিঘ্নানাশক শ্রী গণেশাই নোমোহ
Lord of the rings -- mordor
।                             পেট পূজা
।           চিকেন skewer (নিন্দুকে বলে কুকুরের)
  সেই মায়াবী আলো 

Life is finite,, don't waste your time ageing gracefully, rather do crazy things,and in the end have an wonderful story to tell

A few pics taken by my friend Avik (@wildspeedbird)

Comments

Popular posts from this blog

Bai tu long bay.....the land of the dragons

The misadventures of Tawang