ভদকা ও ভূতের গপ্পো - পার্ট ২

প্রথমেই বলে দি এটায় কোনো ভদকা নেই, বরং চিভাস রেগাল আছে। আর আছি সেই চার বন্ধু, অর্ক, যশ, আমি আর নিকুঞ্জ; উপলক্ষ নিকুঞ্জের বিয়ে। স্থান নিকুঞ্জের  হাভেলির খোলা ছাদ। তা বিয়ের দিনে বর ছাদে কি করছে তা আপনারা জিজ্ঞেস করতেই পারেন, কিছু না সামান্য মদ্যসেবন,সঙ্গে গঞ্জিকা। ওরকম নাক সিটকানোর কোনো কারণ নেই, এটা আপনার ভেতো বাঙালি বিয়ে না, রীতিমতো Marwari বিয়ে । এরপর ঘোড়ায় চড়ে ব্যান্ড তাশা বাজিয়ে আমাদের নিকুঞ্জ বিয়ে করতে যাবে, তাই স্বাধীনতার শেষ উদযাপন। তা সংসারের মায়াজালে সাফার ও suffer করবার আগে,এটা ওর swan song। আপনারা আবার বড্ড উসখুস করছেন - বলছেন ভূত কই। আরে একটু সুবুর করুন, এটা ইনস্টাগ্রাম এর reel নয়,যে swipe করলেই ভূত এসে যাবে। এ গল্পে ভূত ও আছে, অল্প স্বল্প  সুড়সুড়ি মার্কা প্রেমও আছে (আগে থেকে A+ রেটিং এর আবেদন জানিয়ে রাখলাম) আর আছে নেকড়ে। 

তা যা বলছিলাম, এই আড্ডায় মধ্যমণি হচ্ছেন আমাদের সবার সবজান্তা ব্যাঞ্জো দা। পিতৃদত্ত নামটি কবেই হরিয়ে গেছে। এমনকি ব্যাঞ্জো দার বউ ও ওকে ওই নামেই ডাকে।আমরা যখন ইন্টার্ন ছিলাম, তখন ব্যঞ্জোদা সার্ভিস পিজিটি মেডিসিন এ। দাদা হচ্ছে  ৫ আনা টেনিদা, ৫ আনা rambo (সাহসে,শরীরে নয়)! বাকি চার আনা যে বিধাতা কি দিয়ে বানিয়েছে, তার হদিস আমি এখনো পাইনি। দেখতে রোগা টিংটিংয়ে, পেটানো শরীরে একটা ছোট্ট অসস্তিকর ভুঁড়ি, আর খৈনি খাওয়া লাল দাঁত। কিন্তু দাদার চোখে এক অদ্ভুত মাদকতা আছে, কত যে মেয়ে ওই কুহুকিনীর প্রহেলিকায় খেই হারিয়েছে তার ইয়োত্তা নেই। তা এই সবে তৃতীয় পেগ ঢালা হচ্ছে,আর নিকুঞ্জ কে আমরা তিন বন্ধু নারী হৃদয়ের নানা ঘাত প্রতিঘাত সম্বন্ধে তালিম দিচ্ছি ,afterall আমাদের এত দিনের বন্ধু বলে কথা। ব্যাঞ্জো দা তাতে মাঝে মধ্যে নিজের অফুরন্ত এক্সপেরিয়েন্স এর ঝুলি থেকে দু একটা চোখা চোখা মন্তব্য ৩/৪ অক্ষরের গালাগালিতে গার্নিসিং করে পরিবেশন করছে। ভূত আস্তে এখনো পেগ দুই বাকি, তাই এবার পরিবেশন থেকে আমরা পরিবেশের দিকে নজর দি। জায়গাটা নাম ফোর্ট Begu, ১৪th century এর ফোর্ট। বেগু দক্ষিণ রাজস্থানের একটা ছোট্ট প্রদেশ, chittor (হ্যাঁ,সেই রানা প্রতাপের Chittorgarh) আর বুন্দি (রবীন্দ্রনাথের নকল বুন্দির কেল্লা) মাঝে চিড়ে চ্যাপ্টা একটা ছোট্ট প্রদেশ। তারি সবচেয়ে দক্ষিণ দিকের ছাদে, খোলা আকাশের নিচে আমরা আগুন জ্বেলে bonfire করছি। পূর্ণিমার রাত,কিন্তু মেঘে চাঁদ ঢেকে গেছে, বর্ষাকাল চারিদিকে ব্যাঙ ও ঝিঁঝিঁ র ডাক। ৬ নম্বর পেগ ঢালতে ঢালতে নিকুঞ্জ বললো,দাদা কুছ কাহানি সুনাইয়ে। ব্যাঞ্জো দা বললো কিসের গল্প শুনতে চাস বল? আমরা চারজনেই একসাথে বলে উঠলাম ,ভূতের।

 গাঁজায় লম্বা টান দিয়ে বললো,তাহলে শোন। তখন আমি সবে মাত্র মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছি।ঠিক করলাম,মা বাবার বেকার সন্তান না থেকে দেশ সেবা করব। তা চেয়েছিলাম দুর্গাপুরে বাড়ির কাছে পোস্টিং, তা সরকার বাহাদুরের তো রসের অভাব নেই, কোনো এক আমলা দুর্গাপুরের জায়গায় পোস্টিং দিলো দুরবাজপুরে, বীরভূম আর ঝাড়খণ্ড বর্ডারে এক মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম।তোরা তো সব শহুরে বাবু, phc কি তা জানিস না। PHC হচ্ছে পৃথিবীর নবম আশ্চর্য্য। কয়েকটা ভাঙ্গা চোরা বিল্ডিং, যাতে রোগী ভোগী ও ত্যাগী,সবার অবারিত দ্বার। আমাদের phc ও আলাদা কিছু নয়, শুধু চারিদিক বড্ড শুনশান, আর জঙ্গল গাছ গাছালি আর আগাছায় ভরা। গ্রাম বাংলার বেশির ভাগ প্রাইমারী হেলথ সেন্টার তৈরি হয় কোনো দান করা জমিতে। তো আমাদের Phc ও তাই, শুধু স্বাস্থ্য ভবনের যে বাবু টি ফাইল এ অ্যাপ্রুভাল দিয়েছিলেন,তিনি দেখেননি যে জমিটা আসলে একটা কবরস্থান।আমিও জানতে পেরেছি অনেক পরে। যাইহোক যেদিন রাত্রে পৌঁছলাম,সেদিন স্টেশন এ ৩০-৩৫ এর  ছেলে দাড়িয়ে আছে বাইক নিয়ে।ওর নাম মাধব, সবাই মেধও বলেই ডাকে। ছেলেটি ফার্মাসিস্ট , বছর পাঁচেক এখানে আছে। গ্রামের রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে, ছোট্ট নদীটাকে বায়ে ফেলে আমরা ঢুকলাম জঙ্গলের রাস্তায়। অরণ্যের নিস্তব্দতা চুরমার করে এগিয়ে চলেছে আমাদের বাইক, গাছের ফাঁকে পূর্ণিমার আলো এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। মনে মনে ভাবলাম, দু এক পিস বাঘ না থাক, জিন পরী থাকা অস্বাভাবিক নয় ! হঠাৎ করে সজোরে ব্রেক কষাতে চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেলো। স্যার চলুন আপনার কোয়াটার টা দেখিয়ে দি। তা কোয়ার্টার বলতে একটা রুম ,তাতে এক পিস তক্তপোষ, একটা টেবিল ও চেয়ার, সঙ্গে এটাচড বাথরুম। হঠাৎ দরজার সামান্য কড়া নাড়ার আওয়াজ, কিছু চুড়ির আর পায়ের নূপুরের এলোমেলো আওয়াজ এলো,মাধব এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। স্যার,আমার বউ বলল, রাত্রে আমাদের কাছেই খেয়ে নেবেন। আমি বললাম, দরজার পেছনে কেনো,সামনে আসতে বল না,আমি বাঘ ভালুক নই। এটা শুনে আমরা ৪জনেই অল্প বিস্তর বিষম খেলাম, নিকুঞ্জ ব্যাটা তো কাশতে কাশতে দম আটকে মারাই যাচ্ছিল। ব্যাঞ্জো দা আমাদের পাত্তা না দিয়েই বলতে লাগলো, তারপর দরজা ঠেলে যিনি এলেন,লণ্ঠনের আলোয় (বলা হয়নি, phc তে কারেন্ট নারীর হৃদয়ের চেয়েও চঞ্চলা!) যাকে দেখলাম তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই, জয় গোস্বামী বলে গেছেন -
চারু নিতন্ষিনী 
কুঞ্জর গামিনি
বিশ্ব-বিলোচন-লোভ।।
পীন-পয়োধরা
 বন্ধু-জীবাধরা
ইন্দু-বিনিন্দিত-শোভা!!
নিকুঞ্জ ফেল ফেল করে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো ইস্কা মতলব?  আমি পাত্তা না দিয়ে বললাম ,এ রস নিজেকে পান করেতে হবে দোস্ত, খাইয়ে তো দেওয়া যাবে না।

 গাঁজায় আরো এক টান দিয়ে আবার শুরু করলো। তা মনটা একটু শান্ত হলো,এই দণ্ডকারণ্যে অন্তত রম্ভা মেনোকা না হোক, এই ঘৃতাচি তো আছে,যাক বছর দুইয়ের পোস্টিং খারাপ কাটবে না। ওরা ঘর থেকে বেরোতেই,আমি সাবান তোয়ালে বের করে চান করতে গেলাম। সাবানটা সবেমাত্র ভালো করে গা এ মেখছি,অমনি -- যশ এতক্ষণ চুপ করে আকাশের তারা গুনছিল,তড়াক করে উঠে বলল, ভূত দেখলে। ব্যাঞ্জো দা পিঠে একটা পেল্লাই কিল মেরে বললো,এরপর কথার মাঝে ফুট কাটলে তোকে আমি phutshilong পাঠিয়ে দেবো। 
তো আমি কি বলছিলাম যেন, ও হ্যাঁ সাবান। হঠাৎ চোখ পড়ল জানলার দিকে, একজোড়া জ্বলজ্বল চোখ আমার দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে যে কি ভয়ঙ্কর চাহনি বলে বোঝাতে পারবো না।ততক্ষণে আত্মা রাম খাঁচা ছাড়া। অনেক কষ্ট, বেরিয়ে জোরে জোরে মাধব কে ডাকতে লাগলাম। মাধব এর জায়গায় তার বউ এলো,এবার ঘোমটা ছাড়াই। বাবুজি ও তো মাংস কিনতে গেছে। ওটা কি বাথরুম এ,আমি আঁতকে জিজ্ঞেস করলাম। মাধবের বউ হারিকেন নিয়ে বাথরুম এর দিকে এগোলো,আমি ভয়ে পেছনে --- এবার অর্ক ফুট কাটলো, ব্যাঞ্জো দা আর বেশি কাছে এগিয় না, সেন্সর বোর্ড কেটে দেবে! ব্যাঞ্জো দা পাত্তা না দিয়েই বলতে লাগলো, খিল খিল করে মেয়েটা হেসে উঠলো,ও নেকড়ে হ্যাঁ বাবু সাহাব, ও কুছ করবে না। বলে হারিকেন টা রেখে চলে গেলো। আমিও নমোহ নামোহ করে চান সারলাম। তা প্রথম রাত্রি তো সেই নেকড়ের সন্দিধ্যেই কাটিয়ে দিলাম। পরের দিন সকালে phc তে গেলাম। আমার সহযোদ্ধা আরো দুজনের সাথে আলাপ হলো, এক হচ্ছে রামগোপাল,দেহাতি বিহারী। রাতের বেলায় সে তাড়ি আর গঞ্জিকা সেবন করে মুক্তিভার্সের ৯th ডাইমেনশন এ গিয়ে ভগবানের সাথে লুডো খেলে। আর হচ্ছে ললিতা নার্স। সত্যিই বাবা মা এর সার্থক নামকরণ। অর্ক একটু বাঁকিয়ে বললো, তা এই ললিতা দেবীর জন্যে জয়দেব ,নিদেন পক্ষে কালীদাস কিছু শ্লোক talk লিখে যাননি। ব্যাঞ্জো দা শচীনের মতো বাউন্সার টা ডজ করে বলতে লাগলো। কাজ  সামান্যই। দুপুরের মধ্যে লাঞ্চ সেরে, ভাতঘুম দিয়ে, বিকেলে নদীর ধারে একটু চরে, রামদুলালের পর্ণকুটিরে বাবাজির প্রসাদ সেবন করে, সবেমাত্র পড়তে বসেছি হঠাৎ বিশাল বৈশাখের দুপুরে কালবৈশাখীর কুঝটিকার মত এক দমকা হাওয়ায় মোমবাতি নিবে গেলো। একটা নারীকন্ঠে ফোপানো কান্নার আওয়াজ পেলাম ঘরে,তার সাথে এক চেনা চেনা মিষ্টি সেন্ট এর গন্ধ।
 অর্ক ভয়ে আমার দিকে সেঁদিয়ে এলো,ভূত !!!
ব্যাঞ্জো দা দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললো তোর মাথা! আলো জ্বেলে দেখলাম, ললিতা নার্স, চুল আলুথালু, কালো দুচোখ জলে টইটুম্বুর। তোরা তো জানিস,আমি কোনো মেয়ের দুঃখ দেখতে পারি না। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, কি হয়েছে? কান্না, ফোপানি আর মহাভারতের উপাখ্যানের মাঝে যা বুঝতে পারলাম তা হলো ,রম্ভা মেনকা কেস। মাধব একটু বেশি কথা বলছিল আজ ললিতার সাথে, তাই মাধবের বউ দু কথা শুনিয়েছে ওকে। এখুনি এর বিহিত করতেই হবে আমায়,নইলে ও কাল সকালেই ট্রেন ধরে বাড়ি চলে যাবে।আমি দেখলাম এ তো মহা আপদ, কূল ও রাখতে হবে আবার শ্যাম ও! অনেক কষ্টে অনেক সাধ্যসাধনায় ওকে শান্ত করলাম। বললাম রাত হয়েছে, কোয়াটার এ যাও,কালকে দেখছি। মেয়েটা আস্তে আসতে উঠে দরজার দিকে এগুলো, বেরুনোর আগে একবার ঘুরে মিষ্টি হেসে বলল, স্যার, আপনি কিন্তু খুব ভালো!
 যশ ফিস ফিস করে বলল, ১০,০০০/- টাকার বেট তোর সাথে, দাদা নির্ঘাত চুমু খেয়েছে, ওটা সেলফ সেন্সর করে দিলো।

 এই ওইরকম ফিস ফিস কি করছিস রে, জানিস আমি কচ, নিষ্কাম মুক্তমনা পুরুষ। ওসব বাজে কথা আমার নামে রটাবি না। 

এই যশ একটু চুপ করবি, ব্যাঞ্জো দা। তুমি বলো, ওই বাচ্চাটার কথা মাথায় নিয়ো না, নারী চরিত্রের ও কি বা বোঝে!আবার গল্পের গরু তালগাছে উঠতে শুরু করলো, এখন আমার সবাই ৮থ পেগ এ আছি, ব্রহমলোকে বলা চলে।

তো,ললিতা যাওয়ার পর আমি ছিটকিনি টা লাগিয়ে দিলাম, আজ আর আপদ চাই না, ভালো করে এবার পড়ি। ঘন্টা খানেক পরে দরজায় বাইরে হালকা  ঠক ঠক । পাত্তা দিলাম না, হওয়া হবে। কিছুক্ষণ পর,আবার ,,,,,, নেকড়ে টা এসেছে নাকি আবার! বাইরের ঠক ঠক এর সাথে মনের হৃৎস্পন্দন ও ঠক ঠক হচ্ছে। উচুঁ গলায় বললাম, যদি ভূত হও তো দরজা খুলে এসো। দ্বিতীয়বারের জন্য ঘরের মোমবাতি নিবলো, আর একটা বিচ্ছিরি পোড়া গন্ধ। এবার টর্চ টা জ্বালালাম, বোধহয় হাওয়ায় খুলে গেছে ছিটকিনি টা, আর মাধবের বউ দূধ পুড়িয়েছে। মাধব কে বলে এলাম,আজ আর খাবো না, ঘুমিয়ে পড়লাম!
রাত কত মনে নেই, ঘুমটা ভেঙে গেলো কি একটা খোস খোস আর মিহি ঝন ঝন  আওয়াজ! ওটা কি নূপুরের আওয়াজ, মাধবের বউ নূপুর পড়ে বটে,কিন্তু এত রাত্রে। কোথায় যাচ্ছে। রেডিয়াম এর ঘড়ি তে তখন রাত দশটা। আমি বললাম, ধুত্তেরি, কার বউ কার কাছে যায় আমার তাতে কি। ঘুমোই। শীতকাল,তাই কম্বল টা মাথার ওপর টেনে নিলাম। ঘুমটা আর একটু গাঢ় হয়েছে, কি আবার সেই একই আওয়াজ, মনে হোল বাথরুম থেকে আসছে। সাহস সঞ্চয় করে টর্চ নিয়ে উঠলাম, এমনিতেই প্রচণ্ড প্রসাব পেয়েছে, তাই উঠেতেই হতো। লাইট টা জ্বেলে (কারেন্ট চলে এসেছে তখন), বাথরুম করে জল ঢালতে গিয়ে দেখি একদলা মেয়ের চুল বাথরুম এর এক্সহস্ট পাইপের কাছে দোলা পাকিয়ে পড়ে আছে। ও ব্যাটা মাধবের বউ নির্ঘাত এখানে আগে চান করত, কালকেই পরিষ্কার করতে বলতে হবে।পরেরদিন মাধব কে বললাম, এই তোর বউ কে আমার বাথরুম ইউজ করতে বারণ করিস আর রামদুলাল কে দিয়ে বাথরুম পরিস্কার করাস। মাধব কিরকম একটা অদ্ভুত চাহনিতে আমার দিকে তাকালো, কিছু না বলে চলে গেলো। মনটা অনুশোচনায় ভরে গেলো, নাহ ওরকম বলা উচিত হয়নি ওকে। যাকগে ওপিডি তে যাই।

সে রাত্রে আবার সেই রাত্রি দশটায় একই জিনিসের পূরনাবৃত্তি, খোস খোস আওয়াজ বাথরুম থেকে, আর বাইরে হালকা নূপুরের শব্দ। তার সাথে সেই পোড়া গন্ধ। মাধবের বউ কি রোজ দুধ জ্বাল দেই নাকি এত রাত্রে। যায় হোক, আবার বাথরুম গিয়ে দেখি একগাদা মেয়ের চুল exhaust pipe ব্লক করে দিয়ে জল থৈ থৈ করছে ! জলের পাইপ ও লিক করছে নাকি? রাগে মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠলো, বেরিয়ে মাধব কে ডাকতে লাগলাম। সে বেচারা আধো ঘুমে এসে বলল,স্যার আপনি ঘুমন ,আমি কাল সকালে সাফ করিয়ে দেবো। মানে,তুই আজকে করাসনি। যতসব ফাঁকিবাজের দল। মাধব কিছু বলল না, আবার সেই সকালের মতো এক খানি চাহনি দিয়ে, নিজেই পরিষ্কার করলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো, যা কিছু হোক বাথরুম এর দরজা খুলবেন না। দরকার হলে আমার কোয়ার্টার এ আসবেন। 

পরেরদিন ভোর ভোর দেখি মাধব হাজির, সাথে রামদুলআল। সাথে যন্ত্রপাতি ।আমায় এক প্রকার ঠেলে সরিয়ে বাথরুম ঢুকলো। তারপর exhauster পাইপের মধ্যে খোচা খুচি করতে লাগলো, হঠাৎ টুং করে কিসে একটা ধাক্কা লাগলো। রমদুলাল একটা বাঁকানো আঁকসি দিয়ে একটা ছোট্ট হাড়ের টুকরো বের করে আনলো। আমি এতক্ষন নিজ গৃহে পরবাসীর মত বেবুক হয়ে বসে ছিলাম। মাধব হাড়ের টুকরো টা আমার নাকের ডগায় ধরলো, অনামিকা, আর রবির প্রথম আলোয় তার গা থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে এক অদ্ভুত রং! কানের পেছনে থেকে কে যেন বলে উঠলো, এ তো হিরে।মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম,ললিতা দেবী কখন আমার পেছনে গা ঘেষে দাড়িয়ে আছেন। 

মাধব:  রামদুল্যাল,তুমি তো জানো কবরটা কোথা ,যাও ওটাকে সেখানে পুঁতে এসো। আর ফেরার পথে, পীরবাবা কে খবর দিয়ে এসো, এদিক যেন ঘুরে যান। আর স্যার, আপনি আমার বাড়িতেই আজ থাকুন, আসা করি কাল থেকে আপনার বাথরুম এ কোনো অসুবিধে হবে না।
আমি বেবুকের মত মাথা নাড়ালাম।

তারপর! আমরা চারজন একসাথে জিজ্ঞেস করলাম।

 ব্যাঞ্জো দা আবার বলতে শুরু করলো। ঘন্টা খানেক পর আমি আর মাধব বসে আছি মাধবের ঘরে। সঙ্গে লোকাল থানার ইন্সপেক্টর বক্সিও হাজির। মাধবের বউ লুচি ভাজছে, আর ললিতা আমাদের দিচ্ছে, দুজনের এখন বিশাল ভাব। ইন্সপেক্টর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল,  ললিতা রান্না ঘর থেকে , স্যার একটু দাঁড়ান,আমিও কিন্তু শুনবো। কিছুক্ষণ পর চা খেতে খেতে ইন্সপেক্টর বক্সি শুরু করলেন, তো রামডুলাল তুমি তো প্রথম দিক টা জানো,বলো নতুন স্যার কে। রামদুলল শুরু করলো,কি আর বলব বাবু,আগের ডাক্তার সাব বাইরে থেকে খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। আর ম্যাডাম ও। আমাদের রোজ স্নেহ করতেন, পুজোয় ,বিপদে আপদে এটা ওটা দিতেন। কিন্তু উনাদের রাত্রি হলেই রোজ ঝগড়া লেগেই থাকত, মাঝে মাঝে তো রেগে ডাক্তারবাবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেন, কখন সখন ম্যাডাম ও। আমারা ভাবতাম, ও বড় লোকদের ওরকম হয়। তা সেদিন অষ্টমী নবমী তে পর পর ছুটি, কম্পাউন্ডার বাবু বাড়ি গিয়েছিলেন, আগের নার্স দিদি ও ছিলেন না। ডাক্তারবাবু শহরে রুগী দেখতে গিয়েছিলেন, উনি ফাঁকা টাইম এ এদিক ওদিক টুক তাক প্র্যাকটিস করতেন। হঠাৎ একটা বিশাল আওয়াজে আমি ছুটে গেলাম স্যার এর কোয়ার্টার এর দিকে, দেখি ম্যাডাম দাউ দাউ করে জ্বলছে, আর বাথরুমের দিকে ছুটে যাচ্ছেন। আমি কিছু করতে পারলাম না ,,,,,, কান্নায় রামদূলাল এর গলা বুঝে এলো, ফতুয়া থেকে তাড়ির বোতল বের করে ধক ধক করে খেয়ে ফেললো পুরোটা। ইন্সপেক্টর বক্সি বললেন, বাকিটা আমি বলছি। ইনভেস্টিগেশন এ কিছুই পাওয়া যায় নি, গ্যাস লিক করে একসিডেন্টাল ডেথ। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট ও তাই দিলো। কেস ক্লোজড করতে হলো। শুধু আমার মনে একটা খটকা থেকে গেলো। আমি আর ললিতা একসাথে জিজ্ঞেস করলাম কি?
সেদিন জলের ট্যাংক এ একটুকুও জল ছিল না।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়, তার পরেই ডাক্তার বাবু ট্রান্সফার এর অ্যাপ্লিকেশন দিলেন, স্বাস্থ্য ভবনের খুব efficiently তা মঞ্জুর করে দিলো। কি একটা টেকনিক্যাল কারণে যাওয়া টা এক সপ্তাহ delayed হয়েছিল। লম্বা উইকএন্ড ছিল, যেহেতু নতুন ডাক্তার বাবু আস্তে দেরি,তাই সবাই বাড়ি চলে গিয়েছিল,শুধু ডাক্তারবাবু থেকে গিয়েছিলেন,কিছু পুরোনো পেশেন্ট ছিল তাই। সোমবার সকালে আমি থানায় ঢুকছি,দেখি মাধব হন্তদন্ত হয়ে আসছে। স্যার এখুনি কোয়ার্টার এ চলুন। কোনরকমে জীপ টা নিয়ে গিয়ে দেখি, ডাক্তার বাবুর কোয়ার্টার থেকে তীব্র পচা গন্ধ। হাবিলদার কে বললাম, দরজা ভাঙ্গো। নাকে রুমাল চেপে ঢুকে দেখি ডাক্তারবাবুর বডি ফ্যান থেকে ঝুলছে, দরজা জানলা সব ভেতর থেকে বন্ধ, বাকস্য প্যাটরা সব গোছানো। পোস্ট মর্টেম বলল, সুইসাইড।
শুধু........
আবার সেই আমি আর ললিতা,কি?
ফাঁসের দড়িটা ছিল শাড়ি।
তো, ললিতা জিজ্ঞেস করলো,তাতে কি হলো।
মাধবের বউ এই প্রথম মুখ খুলল, ম্যাডাম মারা যাওয়ার পর সব শাড়ি ডাক্তার বাবু বিদেয় করে দিয়েছেন।

আমার সবাই চুপ করে শুনছিলাম।শীতকালের ঘন কুয়াশার মতো বিষাদ আমাদের ঘিরে ধরেছিল। হঠাৎ নিচ থেকে আওয়াজ এলো, ও নিকুঞ্জ তাইয়ার হ যা, ঘোড়া আ গ্যেয়া হ্যাঁ। যশ জিজ্ঞেস করলো,আর ওই খোস খোস শব্দ.....ও, ওটা, ; ওটা একটা সাপ ছিল। রাত্রে ইঁদুর খুজতে ঢুকতো।
বোঝো!


Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

Sri Lanka - the land of experiences!

Bai tu long bay.....the land of the dragons

Bhutan- a breath of fresh air!