গ্রামের নাম বিকনা

"বিকনা আবার কোনো নাম হতে পারে নাকি? এর মানে কি?", বাঁকুড়া থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার রাস্তাটা ধরতে ধরতে আমি আলতো ভাবে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলাম অনামিকার দিকে।
     " তুই নিজেই গিয়ে জিজ্ঞেস করিস।বোধহয় বিক্রি শব্দের অপভ্রংশ বিকনা। আরে আরে,কোথায় যাচ্ছিস, রাইট টার্ন নে।" 
    আমি মাইকেল শুমাকারের মত ঘ্যাচাং করে একটা ১২০* টার্ন নিলুম,আর সজোরে ব্রেক। " উল্লুক কোথাকার", সজোরে মাথায় গাট্টা। "নেমে আয় "। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে, নেমে এসে দেখলাম একটা খুবই সুন্দর তোরণ, ওপরে লেখা, বিকনা ডোকরা শিল্প ডাঙ্গা,বাঁকুড়া। তোরণের শোকেসে ডোকরার কাজ। "আমি তো ভেবেই বসেছিলাম এটা বিষ্ণুপুরের মাটির ঘোড়া তৈরির গ্রাম!" আমার কথা পাত্তা না দিয়েই বললো, "চল, এগোই "
     তো আমি অনামিকার পিছু ধাওয়া করলাম। গ্রামটা যেন ঠিক গ্রাম না,কেমন যেনো অগোছালো চারিধার। বিধাতা যেন অনেককিছু একসাথে দিতে গিয়ে গুবলেট করে ফেলেছেন।আমি এর আগে নয়া গিয়েছি, পটুয়া দের গ্রাম। সে যেন আর একটু সাজানো গোছানো ছিল, আর দেখেছিলাম ওড়িশার গ্রাম, সে তো রং তুলি দিয়ে আঁকা ছবি। ঢুকতেই পার্কিং এ দেখতে পেলাম দেয়াল জুড়ে জামিনি রায়ের কালীঘাটের পেইন্টিংএর অপটু প্রতিলিপি (কোনো সরকারি আমলার ভালবাসার ফসল।)। তারপর সরু রাস্তা ধরে  আমরা এগিয়ে চললাম। ঠিক রাস্তা নয়, মুখোমুখি  এবড়োখেবড়ো বাড়ি, একে অপরকে যেন জড়িয়ে ধরতে চায় ,নেহাত একটি মাঝে না বলা রাস্তা। রাস্তা হঠাৎ শেষ হল দেবতার মন্দিরে। মন্দির তো নয়, উন্মুক্ত আকাশের নিচে চাথলের ওপর তেত্রিশ কোটি দেবতার সহবস্থান। দেবতা বলতে ঘোড়া হাতি আর নাম না জানা মূর্তি সব। গ্রামের দৈন্যদশা ঘুচে গেছে দুধারের পসরায়। ছোট ছোট টেবিলের ওপর রাখা আছে অপূর্ব সব ডোকরার কাজ, যেনো কোনো ষোড়শী মেয়েকে অলঙ্কারের সাজিয়ে তুলেছে তার মা, শুধু ভুলে গেছে যত্ন করে চুলটা বাঁধতে। দিনটি ছিল বিশ্বকর্মা পুজোর দিন,তাই তারস্বরে বক্স বাজছে। কোনো ভোজপুরি গান, কিছু বাচ্চা ছেলে মেয়ে তাতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচছে। বিশ্বকর্মার পুজোর দিন আসল বিশ্বকর্মার সন্ধানে এসেছি। নাহ দিনটা আজ সার্থক ।
      অনামিকার কথায় তন্দ্রা ভাঙলো, কি এত ভাবছিস বল তো, এই virgo গুলো কে নিয়ে এই সমস্যা, বড্ড বেশি ভাবে। চল, ওই বাড়িতে চল, বলে পাকড়াও করে হন হন করে একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেলো। আমি মৃদ্যু প্রতিবাদ করতে গেলাম, এমনি হট করে কি কারো বাড়িতে ঢোকা যায়। রাখ তোর শহুরে আদব কায়দা, বলে জুতো খুলে খালি পায়ে একটা অর্ধ নির্মিত পাকা বাড়ির দালানে বসে পড়ল। ও পিউ বৌদি, এই দাদা কে ধরে নিয়ে এসেছি সেই সুদূর কলকাতা থেকে ,ওই দিনের জিনিস গুলো একবার দেখাও তো। বৌদি তখন তার দুধের মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত। অনামিকা তো মেঝে তে বসে গেলো, আমায় নিয়ে পড়ল সবাই ফাঁপরে। বুড়ি থাম্মি বলে, ও কে চেয়ারটা দাও,কে একজন বলল আসন পেতে দাও। মাঝ খান থেকে অনামিকা  ফুট কেটে বললো, কি রে এই দেড় মণ শরীর নিয়ে নিচে বসতে পারবি তো? আমি দেখলাম, বেশি আতিথেয়তার সুযোগ দেওয়া উচিত নয়, তাই আমিও নতুন প্যান্ট এর মায়া না বাড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়লাম। মেঝেতে তিল ধারণের জায়গা নেই, চারিদিকে সব অপূর্ব  ডোকরার কাজ, ঝুড়ি থেকে এক একটা বেরোচ্ছে, আর আহা কি সুন্দর , বলে হতবাক হচ্ছি। অনামিকার ভোকাবুলারি এমনিতেই সীমিত, সে শুধু যেটা ভালো লাগছে সেটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে আমায় দেখাচ্ছে, আর বলছে খুব সুন্দর না? দালান ছোট, তার মধ্যে বসে অনামিকা আর আমি, একদিকে সোমনাথ, অন্যদিকে তার বাবা, কোলে বাচ্চা মেয়ে( পিউর মেয়ে), আর অন্যদিকে তার দিদি খেলে বেড়াচ্ছে। স্থানের অপ্রতুলতার জন্যে, জিনিস সব ডাই করা, আমরা এক একটা হাতে নিয়ে দেখছি, আর বিভোর হচ্ছি। ছোট্ট বাচ্চারা যেমন খেলনা দেখলে সব নিয়ে নিতে চায়, আমাদের মনে হচ্ছে এই সব কিছু বাড়ি নিয়ে চলে যাই। মোটামুটি কয়েকটা তার মধ্যে পছন্দ করে কিনব বলে আমরা ঠিক করলাম। দরদামের ব্যাপারটা অনামিকার ওপর ছেড়ে দিয়ে, আমি পিউর শশুর মশাইয়ের সাথে গল্প শুরু করলাম। 
     তো আপনারা কি চিরকাল এখানেই থাকতেন?
      নাহ, অনেক পুরুষ আগে ছোটোনাগপুর অঞ্চলে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়াতো, এখন কয়েক পুরুষ ধরে এই গ্রামে আমরা ২৫-৩০ টা পরিবার থাকি। কর্মকার পদবিটাও বোধহয় পরে এসেছে। 
    এই ডোকরাগুলো তো অসাধারণ, বানান কি করে।
অনামিকা দরদাম আর তার মাঝে পিউর বাচ্চাকে আদর করতে করতে বলে উঠলো, ইশ তোকে দেখানো গেলো না এদের কারখানা।আজ পুজো তো,বোধহয় বন্ধ।
      হ্যা মা, আজ বন্ধ সবকিছু। নেহাত তুমি আসবে, তাই।
       কিছু না, প্রথমে এরা একটা ছাঁচ বানায়,তার পর তাতে মোম বা লাক্ষা দেয়, তার পর তাতে তারের কাজ করে, তারপর ফার্নেসএ পোড়াই করে। ওটা কিন্তু পুরো গ্রাম একদিনে করে। তারপর তার ওপর পালিশ হয়, পালিশ আবার তিন রকম। আমি দেখলাম, জিনিসটা গ্রীক হিব্রু আমার কাছে, বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লাম। (না বুঝতে পারলে অনামিকা সারাদিন পাখি পড়ার মত আমায় বোঝাবে, খুবই নাছোড়বান্দা টিচার কিনা!)। 
     ততক্ষণে দুটো রাজভোগ আমাদের সামনে বিরাজমান, পুজোর দিনের প্রসাদ। মিষ্টিটা মুখে পুরে,জিজ্ঞেস করলাম, তা আপনারা অনলাইনে বিক্রি করেন না ? 
     সোমনাথ (পিউর বর) বলে উঠলো, করি তো, একটা ওয়েবসাইট ও বানিয়েছি। 
     আমার কিন্তু অনলাইন ঠিক পছন্দ নয়, সোমনাথ এর বাবা বলে উঠলেন। আসলে কি বলুন তো, অনলাইন এ ছেলে নতুন কিছু ডিজাইন করলো, লোকজন ফোন করে দাম জিজ্ঞেস করল, তারপর অন্য কারো কাছ থেকে একই জিনিস সস্তায় বানিয়ে চলে গেলো।
  বুঝলাম, IP rights, copyright এসব এখানে প্রহেলিকা মাত্র। কিছুটা নবীন প্রবীণ দ্বন্দ বটে। জিজ্ঞেস করলাম, সংসার চলে এতে। 
     চলে যায়, কিন্তু চেষ্টা করছি ব্যবসাটাকে ভালো একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার। মুখফুটে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, সরকারি সাহায্য পান? যাই হোক, জিনিসপত্র সব ব্যাগ ভর্তি করে গাড়িতে তুলে আমরা বাঁকুড়ার দিকে এগোলাম।

  অনামিকা গুনগুন করে কি একটা গান গাইছিল,হঠাৎ থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,কি ভাবছিস বল তো?আমি পাল্টা জিজ্ঞেস করলাম, বিশ্বকর্মা নিজের ইচ্ছেতে কি কিছু বানিয়েছিল, নাকি সব ফরমায়েশি। বিশ্বকর্মা কারিগর নাকি শিল্পী?
   তুই তো বলেছিলি, বিশ্বকর্মা ব্রহ্মান্ডের সব চেয়ে সুন্দরী মেয়ে তিলোত্তমা কে বানিয়েছিল। বিশ্বকর্মা আসলে শিল্পী।
আমি বললাম,তাই হবে। 
   হঠাৎ সজোরে ব্রেক কষে বললাম, বাঁদিকে দেখে।শরতের নীল আকাশের নিচে বুড়ো দ্বারেকেশ্বর সাদা কাশফুলে কি অপূর্ব সাজে সেজে উঠেছে। চল, কয়েকটা ছবি তুলি। পড়ন্ত বিকেলের রোদে মায়াবী লাগছিল...... 
গয়নার বাক্স 
অনামিকার এটা নেওয়ার খুবই ইচ্ছে ছিল।
কতরকমের যে দুর্গা দেখলাম,তার ইয়োত্তা নেই।
সোমনাথ, শিল্পী ও শিল্প
রকমারি দুর্গা, অনমিকা সবার নাম বলেছিল, কিন্তু আমার মনে নেই।

মেয়েটির নাম লক্ষ্মী, আমার কাছে Athena 
পিউর শশুর মশাই
এই ওদের বিশ্বকর্মা।
চুল্লি

আমি ও বুড়ো দ্বরেকেশ্বর।
 যা কিনলাম
তালপাতার সেপাই।

থাক ছবি এই পর্যন্তই।
বাকি দেখতে হলে অবশ্যই যাবেন -
https://somnathdokra.com/

Comments

Popular posts from this blog

Sri Lanka - the land of experiences!

Bhutan- a breath of fresh air!

Bromo র চিঠি