আমার পুজো
আমি কোনো সেলিব্রিটি নই। তার চেয়েও বড় কথা আমি এখনো বুড়ো হয়ে যায়নি। তাই আমার স্মৃতিরোমন্থন করা বাতুলতার পর্যায়ে পড়ে। এটা ফরমায়েশি লেখা নয়, খেয়ালী....না না বদখেয়ালি লেখা বলতে পারো। সব লেখকের মনেই অমরত্বের প্রত্যাশা থাকে, যে ১০০ বছর পরেও কেউ তার লেখা পড়বে, আর সামান্য হলেও তারিফ করবে। যখন স্বয়ং কবি গুরু সেই ফাঁদে পা ফেলেছেন, আমি তো নগন্য কিট পতঙ্গ। সে যাই হোক, আমার মত অর্বাচীনের লেখা কেউ নিজে থেকে পড়ে বলে মনে হয়না,উল্টে আমি লোকজনকে পাঠাই তাদের মূল্যবান সময় অপচয় করতে! অনেক বাজে বকেছি, এবার কাজের কথায় আসি।আজকের বিষয় আমার চোখে দুর্গাপুজো।
বৈষ্ণব বাড়িতে জন্ম,তাই পুজো জিনিসটা সেই জ্ঞান হওয়া থেকে দেখে আসছি। ওই প্রত্যেক বৃহস্পতিবার, লক্ষী ঠাকুরের পুজো। ( শনি ঠাকুর তখনও অত পাত্তা পাননি, আসলে পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়নি ত!) দুর্গাপুজোর মাহাত্ম্য বুঝতে পারলাম স্কুলে ভর্তি হয়ে। ওই সময় একমাসের স্কুল ছুটি, ৫-৬ দিন কোনো পড়াশোনার বালাই নেই।বেশিরভাগ পুজোয় আমরা ঘুরতে বেরিয়ে যেতাম; তাই আলাদা করে দুর্গাপুজোর প্রতি কোনো টান কোনোকালেই ছিল না। স্কুল এ ছুটি পড়ত পঞ্চমীতে। পুজো শুরু হতো ষষ্ঠীর সন্ধায়, দুর্গাদুর্গতিনাশিনীর মঞ্চস্থ করে। পুজোর দিনগুলো ভূভারত পরিক্রমায় না বেরোলে, কাটত ঘরের চৌহদ্দির মধ্যে। প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম (ও আছি) ছোটবেলায়, বন্ধু বান্ধব নেই বললেই চলে ( এখনো আছে কি?) । তাই,পুজোয় ভিড়ে ঠেলাঠেলিতে গা না ভাসিয়ে, বাড়ির কোনো কোণে চুপ করে আনন্দমেলা পড়তাম (কখনও সখনও দেশ, বা আনন্দবাজার পত্রিকা!)! একটা দিন শুধু যেতাম প্যান্ডেল এ, অষ্টমীতে অঞ্জলী দিতে আর খিচুড়ি ভোগ খেতে। মা, দায়িত্ব নিয়ে তার আগের দিন নিরামিষ খাওয়া করাত, আর সকাল থেকে উপোস। নবমীতে মাংস খাওয়ার রীতি কোনো কালেই ছিল না। আর দশমী মানেই দেশের বাড়িতে ছোটখাটো reunion (আমাদের চার কাকু,চার পিসি, আর তাদের কচিকাঁচার দল!)। নতুন জামা পেতুম বলে মনে পড়ছে না( তার পরেই ভাইফোঁটা, সেই সময় জুটত কপালে এটুকু মনে আছে, ভাই কে জিজ্ঞেস করতে হবে!)। খেলনা বলতে বন্দুক,তাও একবার কিনে দেওয়া হতো,একটা আমাদের দু ভাইয়ের জন্যে, রিল এক প্যাকেট ( মা এর কাছে বায়না করে আর ও এক প্যাকেট ভাই জোগাড় করে নিত!)। পুজোয় মুঘলাই আর আইসক্রিম খেয়েছি মনে পড়ে, ওগুলো তখন অমৃত আমাদের কাছে। পুজোর রকম সকম ও খুবই সাদামাটা, থিম বলে কিছু ছিল না, একই রকমের ঠাকুর প্রত্যেক বছর। শহরে যদিও বা কিছুটা বৈচিত্র ছিল, গ্রামে তো পুরো কপি paste। ঠাকুর এখানেই তৈরি হতো ( কুমোরটুলি কি জানতুম না তখন), তাই ওইটা দেখতে বেশ ভালো লাগতো। বোধহয় সৃষ্টির মধ্যে যে আনন্দ তা অন্য কিছুতে নেই। থিমের অভাব পূরণ করতো আন্তরিকতা আর ভক্তি । পুজোর মধ্যে সবার একটা পার্টিসিপেশন ছিল।ভক্তির কথায় একটা হাসির গল্প মনে পড়ে গেলো। তখন বোধহয় ক্লাস ৩ তে। ঠাকুরকে প্রণাম করে চরণামৃত নিতে নতুন জুতো নিচে খুলে মণ্ডপে উঠেছিলাম, নিচে নেমে এসে দেখি জুতো আমায় না বলে একা একা ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়েছে। সেই যে অগোছলা ভাব আর জিনিস হারানোর প্রবণতা, তা এই বুড়ো বয়সে পর্যন্ত রয়ে গেছে। এই পুজোর কথাই যদি ধরি, আজ পঞ্চমিতে আবার চশমা হারিয়েছি ।
হাসির কথা যখন উঠলো, তখন আর একটা কথা মনে পড়ে গেলো। এটা অবশ্য পুজোর আগের কথা। বাড়িতে অনেকসময় আনন্দমেলা নেওয়া হয়ে উঠত না, তখন বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে ধার করে পড়তাম স্কুল এ। কিন্তু তারাও ওটা বাড়ি নিয়ে যেতে দেবে না, তাই কাকুতি মিনতি করে ডেস্কের নিচে লুকিয়ে পড়তাম ক্লাস চলাকালীন। সেবারে ধরা পড়ে গিয়েছিলাম, আর সটান ক্লাস থেকে get out, তাও পরপর দুটো ক্লাস এ। পড়াশুনায় ভালো ছিলাম বলে বোধহয় gaurdian call হয়নি।
আর একবার পুজোর সময় ঘুরতে গিয়ে বিপাকে পড়েছিলাম। স্কুলে পরীক্ষার খাতা দেখানো হতো, আর আমি কোনো একটা সাবজেক্ট এ কম মার্কস পেয়েছি বলে বাড়িতে বেমালুম মিথ্যে বলে দিয়েছি। কিন্তু বিধি বাম, সেবার গিয়েছিলাম হরিদ্বার। সেখানে বাবার সাথে আমারই ক্লাসের এক বন্ধুর বাবার দেখা। ভাগ্যিস জিজ্ঞেস করেনি, নইলে সেই রাত্রে ভাগ্যে উত্তম মধ্যম জুটত। আর হ্যাঁ, দুটো পুজো আমার কেটেছিল হাত ভাঙ্গা plaster করা অবস্থায়। কি করে এত শান্ত ছেলের দু দুবার হাত ভাঙলো, সে গপ্পো না হয় পরে হবে। এই হচ্ছে আমার ছোটবেলার ম্যাড়মেড়ে সাদাকালো পুজোর ডায়েরি।
হালকা হালকা গোঁফ যখন দেখা দিলো,পুজো এলো অন্য বেশে। নাহ, এখনকার মত বান্ধবীর সাথে পুজো পরিক্রমার পারমিশন ছিল না তখন। আড্ডা মারতে যেতাম কিছু পুজোয়, যদি তার দেখা পাই, শাড়িতে, ভেজা চুলে। যদি এসে একটু কথা বলে ( মুখচোরা ইন্ট্রোভার্ট ছেলে, কাউকে ভালো লাগলেও বলে ওঠার সাহস হয়নি কখনও।)
কলেজ প্রেমিকার সাথে পুজো দেখার সুযোগ ছিল, কিন্তু দুজনের বাড়ি ফেরার তাড়া থাকত, তাই একসাথে ট্রেন এ ফিরতুম, আর মনে মনে প্রার্থনা করতুম, কত তাড়াতাড়ি পুজো শেষ হয়, আর আবার দেখা হবে। মোবাইল ফোনের বিলাসীতা ছিল না যে। কাশফুল আর ওই পেঁজা তুলো তখন ছিল বিরহের প্রতীক। পরে অবশ্য দল বেঁধে কলকাতার ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি ( সব ছেলের দল, কারণ বান্ধবী তখন প্রাক্তন হইয়াছেন!)। তাতে মৃন্ময়ীর থেকে চিন্ময়ীতে বেশি ইন্টারেস্ট ছিল আমাদের।মেডিকেল কলেজের dsa র দৌলতে তখন পুজোটাকে মনে হতো পয়সার অপচয় ( এখনো মাঝে মাঝে মনে হয়!) তারপর ইন্টার্নশিপ, অষ্টমীর রাত্রে ট্রেন এ কাটা সুইসাইড কেসের ডিসি লিখে বাইরে চা খেতে বেরিয়ে ভাবলাম টুক করে কলেজ স্কয়ারের ঠাকুর দেখে আসি । দেখলাম,শুধু মা জেগে নেই, মোড়ের চা আর ঘুগনি দোকানি থেকে শুরু করে পুলিশ , সবাই যেন নিজের মতো করে মা এর আরাধনা করছে ( তখন এখনের মত রাত্রে ভিড় থাকত না!) বুঝলাম, এ শুধু পুজো নয়, এ এক বিশাল যজ্ঞ, যাতে মানুষের সুখ দুখ আবেগ অর্থ কাম ভালোবাসা ঘৃণা ত্যাগ কর্ম দান ধ্যান সব মা এর চরণে আহুতি দেওয়া হচ্ছে।
তারপর ঘুরেফিরে আবার প্রেম এলো জীবনে, একসাথে মাড্ডক্স স্কয়ারে আর সুরুচি সংঘ। বিয়ের পরের পুজোটা বাজেই গেলো, ম্যালেরিয়া ভালবেসে আমার দেহে বাসা বাঁধলো।
এরপর সরকারি চাকরিজীবন। কলকাতাবাসী না হওয়ার দৌলতে পুজোর ডিউটি আমাকেই করতে হতো। চেষ্টা করতাম তার মাঝে adjust করে ঘুরতে বেরিয়ে যাওয়া, officialy রাজস্থান বা কাশ্মীর ( unofficially, না বলাই শ্রেয়!)! কিছু ভালো লাগা মানুষের সাথে পুজো তে ঘোরার ইচ্ছে ছিল,কিন্তু সব ইচ্ছে কি সব সময় পূর্ণ হয়। কবি বলেছেন না, সব পেলে নষ্ট জীবন। পুজো মানেই কাশফুল, কঙ্কাবতী আর ভালোলাগার ছবি।
এখন ছেলে মেয়ে হয়েছে, পুজোটা ওদের চোখ দিয়েই দেখার চেষ্টা করি। অনেক ভুলভাল বকেছি,এবার শেষ করার পালা। না,মধুরেন সমাপেত নয়, ঈষৎ শুক্ত রেখে গেলাম শেষ পাতে। ঘটনা আজকের। নানা কারণে,সকাল থেকেই মন টা ভালো ছিল না। ল্যাব এ তাড়াহুড়োয় ছিলাম, কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরব। পঞ্চমিতে কে এত কাজ করতে চায় বলো। বেরোবো বেরোব করছি, টেকনিশিয়ান এসে বলল, স্যার, একটা bone marrow aspiration আছে,সাথে biopsy। ধুত্তেরী, বেরোনোর মুখে যত আপদ। গেলাম করতে, বাচ্চা মেয়ে, বছর ২৫। জিজ্ঞেস করলাম, বাড়িতে কে আছে,বললো বর আর একটা বাচ্চা ছেলে, ৪ বছর বয়স। বর কাঠের কাজ করে, আর্থিক ভাবে খুব একটা সচ্ছল মনে হলো না। Biopsy procedure টা যথেষ্ট যন্ত্রনাদায়ক (anaesthesisa দেওয়া সত্ত্বেও!)। মেয়েটি মুখ বুজে সহ্য করলো। ভাবলাম কাল থেকে তো ছুটি, আজ report টা করেই যায়। দেখলাম Acute leukemia, কতদিন বাঁচবে, তার চেয়ে বড় কথা কতদিন চিকিৎসা করাতে পারবে কে জানে। ল্যাব থেকে বেরিয়ে এলাম, সামনেই একটা পুজোর প্যান্ডেল। গাড়ির কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখতে পেলাম লোকজন নতুন জামা কাপড় পড়ে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে। হঠাৎ কাঁচে মেয়েটার হাসি মাখা ক্লিষ্ট মুখ টা ভেসে উঠলো, ডাক্তারবাবু ভালো হয়ে যাবো তো। আচ্ছা, পুজোর দিনে মিথ্যে বলা কি পাপ?
দূরে মাইকে বাজছে, "তোমারও অসীমে........"
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা,
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়॥
Comments
Post a Comment